গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত কিট যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-সিডিসি পরীক্ষাই করেনি।
দেশে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়ার পর গত বছরের মাঝামাঝি ভাইরাস শনাক্তে সক্ষম র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট উদ্ভাবনের ঘোষণা দেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এই কিট অনুমোদনের জন্য ব্যাপক চাপ দেয়া হয় সরকারকে।
এর অংশ হিসেবে বলা হয়েছিল, সরকার যদি কিটের অনুমোদন না দেয়, তাহলে সিডিসিকে সেই কিট দিয়ে দেয়া হবে।
ওই বছরের ১৭ মে সিডিসি কাছে কিছু নমুনা দেয়া হয় বলে দাবি করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। পরে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠানটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে আরও ৮০০ কিট চেয়েছে।
তবে সিডিসির বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. মাইকেল ফ্রেইডম্যান বলেন, ‘করোনাভাইরাস শনাক্তে গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিট সিডিসি কখনও পরীক্ষা করেনি।’
কেন পরীক্ষা করা হয়নি- জানতে চাইলে সিডিসি কর্মকর্তা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দাবি, চিঠি দিয়ে কিটের সক্ষমতা যাচাই করতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থাটি।
তিনি বলেন, ‘কিটের প্রটোকল তৈরির জন্য কোনো কন্ট্রাক্ট রিসার্চ ফার্মের (সিআরও) সঙ্গে চুক্তি করতে হয়। তাই আমরা আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) সঙ্গে চুক্তি করেছি। তারা কিছু টাকা ও ডকুমেন্ট আমাদের কাছে চেয়েছে। আমরা এ বিষয়ে রাজিও হয়েছি।’
তবে জাফরুল্লাহর সহকর্মী বলছেন ভিন্ন কথা। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জিআর কোভিড-১৯ র্যাপিড ডট ব্লট কিট প্রকল্পের সমন্বয়কারী ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৭ মে একটি অনুষ্ঠানে কিছু কিট যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি প্রতিনিধির কাছে দেয়া হয়। পরে তারা ৭০০ থেকে ৮০০ কিটের চাহিদা দেয়। তবে সরকার এ কিট অনুমোদন না দেয়ার কারণে সিডিসি পিছিয়ে গেছে। এরপর থেকে আর কোনো আপডেট নেই।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলছে, মানোত্তীর্ণ না হওয়ায় অনুমোদন পায়নি এ কিট। এই কিটের সক্ষমতা যাচাই করেছে দেশের প্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। তারা জানিয়েছে, করোনাভাইরাস শনাক্তে কার্যকর নয় গণস্বাস্থ্যের কিট।
তবে নিজেদের উদ্ভাবিত কিট শতভাগ কার্যকর বলে এখনও দাবি করছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
গণস্বাস্থ্যের কিট পরীক্ষা করেনি সিডিসি
গণস্বাস্থ্য উদ্ভাবিত কিট পুরোপুরি কার্যকর নয় বলে জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি তা মানতে নারাজ
তিনি বলেন, ‘কিট সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারে (বিএমআরসি) জমা দিয়েছি। তারা কিটের সক্ষমতা পরীক্ষার বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরও কোনো উত্তর আসেনি।’
তিনি বলেন, ‘এমন ব্যবস্থাপনাকে গালি দিতে ইচ্ছা করে। কোনো কিছুই টাকা ছাড়া হয় না। আমার এতো কষ্ট করে কিট উৎপাদন করলাম। আমাদের কিট ব্যবহার বা অনুমোদন না দিয়ে সরকার বিদেশি কিট নিয়ে করোনা শনাক্ত করাচ্ছে।’
র্যাপিড কিট নিয়ে শুরু থেকেই সতর্ক অবস্থানে সরকার। কারণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোনো ধরনের র্যাপিড কিট ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি। তাদের পরামর্শ ছিল, করোনা শনাক্তে সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি আরটি পিসিআর টেস্ট।
এসব যুক্তি তর্ককে এক পাশে রেখে জাফরুল্লাহর দাবি, আক্রান্ত ব্যক্তির এক ফোঁটা রক্ত দিয়ে ১৫ মিনিটেই করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সক্ষম তাদের কিট। আর তাই ওই টেস্ট কিটের নামা রাখা হয় ‘গণস্বাস্থ্য র্যাপিড ডট ব্লট৷’ তারা মূল্য নির্ধারণ করেছিল ২০০ টাকা৷
শুরু থেকে এই কিট নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে ছিল সরকার ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। চলছিল টানাপোড়েন। ছিল পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। প্রতিবাদে বেশ কয়েকবার সংবাদ সম্মেলনও করেছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
শেষমেশ ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল বিএসএমএমইউকে কিট পরীক্ষার দায়িত্ব দেয় ঔষধ প্রশাসন। অধ্যাপক শাহিনা তাবাসসুমের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফরম্যান্স কমিটি গণস্বাস্থ্যের কিট পরীক্ষা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়ার কাছে সেই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।
তার প্রেক্ষিতে উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া জানিয়েছিলেন, ‘৫০৯ জন রোগীর স্যাম্পলের ওপর এই পরীক্ষা চালানো হয়। এতে প্রথম সপ্তাহে ১১ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে শনাক্ত হয় ৪০ শতাংশ রোগী। তো আমরা কীভাবে বলি, এই কিট কার্যকর? আমরা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জানিয়ে দিয়েছি। এখন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত নেবে।’
বিএসএমএমইউর প্রতিবেদন সন্তোষজনক না হওয়ায়ায় টেস্ট কিটের অনুমোদন দেয়নি ঔষধ প্রশাসন। রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আইয়ুব হোসেন বলেন, মানোত্তীর্ণ না হওয়ায় ওই কিট অনুমোদন পায়নি।
নিজেদের উদ্ভাবিত কিটের এমন পরিণতিতে হতাশ গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজের উপাধ্যক্ষ ও কিটের সমন্বয়কারী ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার। তিনি বলেন, ‘কিট আমরা বানিয়েছি, আমাদের বানানোর আরও সক্ষমতা রয়েছে। তবে আপনার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই।’
ঔষধ প্রশাসনের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘এটা তাদের অফিসিয়াল কথা। এখানে আমাদের স্বীকার করা আর না করার কোনো প্রশ্ন আসে না। এটা তো অলরেডি স্বীকার করে নিতে হয়েছে।’
© স্বত্ত্বঃ নাটোর টাইমস: ২০১৭-২০২৪ --- “নাটোর টাইমস” এ প্রকাশিত/প্রচারিত যেকোন সংবাদ, আলোকচিত্র, অডিও বা ভিডিওচিত্র বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং নিষিদ্ধ।
Leave a Reply