প্রথমবারের মতো বিলুপ্তপ্রায় বাতাসি মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনে সফল হয়েছে বাংলাদেশ। দেশে এখন পুকুরে বাতাসি মাছ চাষ করা যাবে। দীর্ঘদিন গবেষণা করে করোনাকালে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাতাসি মাছের পোনা উৎপাদনে সফল হন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা। এই সাফল্য বিলুপ্তপ্রায় বাতাসি মাছ রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদী তাঁরা। বগুড়া জেলার সান্তাহারে অবস্থিত ইনস্টিটিউটের প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রে এই সাফল্য অর্জিত হয়। জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাদুপানির ২৬০টি মাছের মধ্যে ৬৪টি প্রজাতি বিলুপ্তপ্রায়। এর মধ্যে ৯টি অতি বিপন্ন, ৩০টি বিপন্ন এবং ২৫টি শঙ্কাগ্রস্ত। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ২৫ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় ও দেশীয় মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল ইতিমধ্যে উদ্ভাবন করা হয়েছে। সর্বশেষ সংযোজন হলো বাতাসি মাছ। দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে গত ১৯ মে এ সাফল্য অর্জিত হয়। গবেষক দলে ছিলেন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ডেভিড রিন্টু দাশ, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান এবং মালিহা খানম।
এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিলুপ্তপ্রায় মাছ পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম সম্প্রতি জোরদার করা হয়েছে। ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে ব্যবহারের ফলে দেশীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১২ বছরে পুকুরে দেশীয় মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ (২ দশমিক ৫ লাখ মে.টন)। পর্যায়ক্রমে সব দেশীয় ছোট মাছকে প্রজনন ও চাষাবাদের মাধ্যমে ভোক্তাদের পাতে ফিরিয়ে আনা হবে।’
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাতাসি মাছের বৈজ্ঞানিক নাম ঘবড়ঃৎড়ঢ়রঁং ধঃযবৎরহড়রফবং। এই প্রজাতির মাছ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং মিয়ানমারে পাওয়া যায়। সুস্বাদু এ মাছটি বর্তমানে বাজারে খুব কম দেখা যায়। এ মাছটি দৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর দেহ চ্যাপ্টা ও এর ওপরের চোয়াল নিচের চোয়ালের চেয়ে কিছুটা লম্বা।
গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পরিপক্ব বাতাসি মাছের খাদ্যনালিতে শতকরা ৮৬ ভাগ প্লাংটন ও ১৪ ভাগ অন্যান্য খাদ্যবস্তুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া বছরব্যাপী জিএসআই ও হিস্টোলজি পরীক্ষণের মাধ্যমে বাতাসি মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করা হয়। বাতাসি মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মে-জুলাই। এ মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা আকার ভেদে হচ্ছে ১২০০-২৫০০টি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বগুড়ার সান্তাহার প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র থেকে যমুনা ও আত্রাই নদীসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বাতাসি মাছের পোনা সংগ্রহ করে প্রথমে পুকুরে তা নিবিড়ভাবে প্রতিপালন করা হয়। প্রতিপালনকালে বাতাসি মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয়।
জানা যায়, একটি পরিপক্ব স্ত্রী বাতাসি মাছ ৪.০ থেকে ৬.০ গ্রাম ওজনের হলেই প্রজনন উপযোগী হয়। প্রজনন উপযোগী পুরুষ বাতাসি মাছ স্ত্রী বাতাসির চেয়ে আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট (২.৫-৪.০ গ্রাম) হয়। আলোচ্য গবেষণার আওতায় চলতি মে মাসে বাতাসি মাছকে হরমোন ইনজেকশন দেওয়া হয়। হরমোন প্রয়োগের ১২-১৫ ঘণ্টা পর বাতাসি মাছ ডিম ছাড়ে এবং ২৩-২৫ ঘণ্টা পরে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু পোনা উৎপাদিত হয়। ডিম নিষিক্ততার হার ছিল শতকরা প্রায় ৭৩ ভাগ। উৎপাদিত রেণু বর্তমানে প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের হ্যাচারিতে প্রতিপালন করা হচ্ছে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিবেশ বিপর্যয়সহ নানা কারণে এসব মাছ জলাশয়ে এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। ক্রমান্বয়ে মাছটি বিপন্নের তালিকায় চলে গেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিলুপ্তপ্রায় বাতাসি মাছকে পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে গবেষণার মাধ্যমে ইনস্টিটিউট থেকে এর প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। ফলে এ মাছটি এখন চাষ করা সম্ভব হবে। গবেষক দলের প্রধান ড. ডেভিড রিন্টু দাস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী বাতাসি মাছে পটাশিয়াম ৬১০ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৪০০ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ২০০ মিলিগ্রাম, জিঙ্ক ১৪.৪ মিলিগ্রাম, আয়রন ৩৩.০ মিলিগ্রাম এবং মেঙ্গানিজ ২০০ মিলিগ্রাম রয়েছে, যা অন্যান্য দেশীয় ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি। জিঙ্ক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। করোনাকালে বাতাসি মাছ বেশি করে খাওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা পরামর্শ প্রদান করেন। উল্লেখ্য, বিলুপ্তপ্রায় মাছ রক্ষায় ধারাবাহিক গবেষণা চালিয়ে আসছে বিএফআরআই।
ইতিমধ্যে ইনস্টিটিউট থেকে ২৫ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় ও দেশীয় মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। সর্বশেষ চলতি মাসের ১৮ মে বাতাসি মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনে সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
© স্বত্ত্বঃ নাটোর টাইমস: ২০১৭-২০২৪ --- “নাটোর টাইমস” এ প্রকাশিত/প্রচারিত যেকোন সংবাদ, আলোকচিত্র, অডিও বা ভিডিওচিত্র বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং নিষিদ্ধ।
Leave a Reply